Summary
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মের সময় আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সমাজে মারামারি, চুরি, হত্যা এবং নানা অন্যায় ছিল। তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে দেব-দেবীর পূজা করত। এ সময়ে নারীদের অবস্থাও ছিল খুব করুণ, মেয়ে শিশুদের হত্যার ঘটনাও ঘটত। আল্লাহ তাঁকে পাঠান সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য।
হযরত মুহাম্মদ (স.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ জন্মের আগে মারা যান। তিনি উম্মে আয়মান নামে পরিচারিকার কাছে বড় হন এবং খুব অল্প বয়সে পিতামাতা দুজনকেই হারান। তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁকে লালন-পালন করেন।
হযরত মুহাম্মদ (স.) ১২ বছর বয়সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার দিকে যান এবং সেখানে পাদ্রি বুহাইরার সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি তাঁকে শেষ নবিরভাবে চিহ্নিত করেন। যুবক বয়সে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য 'হিলফুল ফুযুল' নামে একটি শান্তিসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
কাবা ঘরের সংস্কারকালে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে বিতর্ক শুরু হলে, তিনি পরিস্থিতি শান্ত করতে উদ্যোগী হন এবং কাছাকাছি গোত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ পরিহার করেন।
৪০ বছর বয়সে, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নবুয়ত লাভ করেন এবং গোপনে ইসলামের দাওয়াত শুরু করেন। তাঁর অনুসারিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ (স.) ধৈর্যের সাথে তাঁদের কুসংস্কার দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
আরবের অবস্থা
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মের সময় আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ ও জঘন্য। আরবের লোকেরা ছিল নানা পাপে লিপ্ত। মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও অরাজকতা করে তাদের জীবন চলত। তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত। সমগ্র আরবদেশ বর্বরতা ও প্রকৃতি পুজায় নিমজ্জিত ছিল। কাব্যচর্চা, গান ও বাগ্মীতায় অগ্রসর থাকলেও নৈতিক চরিত্রে আরব সমাজ পিছিয়ে পড়েছিল। হাটে-বাজারে পণ্যের মতো মানুষ বেচাকেনা হতো। এদের জীবন-মৃত্যু মনিবের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করত। মনিবরা এদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালাত। ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না। এমনকি সে সময় জীবন্ত মেয়ে শিশুদের গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হতো। এরূপ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে পাঠান। তাঁর আগেও পৃথিবীতে আরও অনেক নবি-রাসুল এসেছেন। আমাদের নবি হলেন সর্বশেষ নবি। সকল নবির সেরা নবি, বিশ্বনবি।
জন্ম ও পরিচয়
হযরত মুহাম্মদ (স.) আমাদের প্রিয় নবি। তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি মাতৃগর্ভে থাকতেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। জন্মগ্রহণের পর তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ ও আহমাদ।
মহানবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও পাদ্রি বুহাইরার ভবিষ্যদ্বাণী
আরবদের বনু সা'দ গোত্রের মেয়ে ধাত্রী হালিমার উপর শিশু মুহাম্মদের লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে। তিনি পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ-মমতায় লালনপালন করেন। এরপর মুহাম্মদ (স.) মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। তিনি মা আমিনার সীমাহীন আদরযত্নে বড় হতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কপালে এ আদরও বেশিদিন জুটল না। তাঁর মাও মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। অল্প বয়সেই তিনি পিতামাতা উভয়কে হারিয়ে ইয়াতিম হয়ে যান। বিশ্বের বুকে তিনি তখন একা, নিঃসঙ্গ ও অসহায় বালক। উম্মে আয়মান নামক একজন পরিচারিকা তাঁকে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের হাতে তুলে দেন। দাদা অত্যন্ত আদরযত্নে তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন দাদাও তাঁকে ছেড়ে পরলোকগমন করেন। এবার তিনি চাচা আবু তালিবের হাতে বড় হতে থাকেন। চাচার সংসারে ছিল অভাব-অনটন। তিনি চাচার ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতা করতেন ও মেষ চরাতেন। চারিত্রিক সকল ভালো গুণ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি অহংকার, অপব্যয়, অর্থহীন ও অনৈতিক কথা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন এবং তিনি অন্যের দোষ খোঁজা ও কাউকে লজ্জা দেওয়া থেকেও বিরত থাকতেন। সর্বদা মানুষের সাথে হাশিখুশি কথা বলতেন। অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হতেন। মানবতার কল্যাণে নিজের সম্পদ অকাতরে ব্যয় করতেন। তিনি ছিলেন সত্যবাদী। তাঁকে আপন-পর সকলেই আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন। এক কথায় তিনি পৃথিবীর সকল প্রাণী ও জীবজন্তুর উপকারী বন্ধু ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বয়স যখন ১২ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া রওয়ানা হলেন। তিনি বসরায় পৌঁছলে বুহাইরা (জারজিস) নামক একজন খ্রিষ্টান পাদ্রির সাথে দেখা হয়। তিনি মুহাম্মদ (স.)-কে চিনতে পেরে বলেন, ইনিই শেষ জামানার নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। পাদ্রি আবু তালিবকে বলেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন, ইহুদিরা তাঁর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী চাচা আবু তালিব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভাতিজাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবি (স.)
ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ফিজার যুদ্ধ শুরু হয়। তা একটানা পাঁচ বছর চলতে থাকে। এতে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। মহানবি (স.) এসব হানাহানি ও রক্তারক্তি অবস্থা দেখে ব্যথিত হলেন। কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি শান্তিকামী কয়েকজন যুবককে নিয়ে 'হিলফুল ফুযুল' নামে একটি শান্তিসংঘ গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন আরবের চলমান হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলে সমাজে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। সকল মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় এবং তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আপন-পর সকলেই তাঁকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন।
কুরাইশগণ বহুদিনের পুরাতন কাবা ঘর সংস্কারের কাজ হাতে নিল। কাবা ঘর সংস্কারের কাজ সমাপ্ত হলো। কিন্তু পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন করা নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হলো। এ ঝগড়া বিভিন্ন গোত্রে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই এ পাথর স্থাপনের মতো মহৎ কাজের অংশীদার হতে চাইল। কেউ ছাড় দিতে রাজি হলো না। তাই গোত্রসমূহের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী দিন সকালবেলা সবার আগে যিনি কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন তিনিই এ বিবাদ মীমাংসা করবেন। তিনি যা সিদ্ধান্ত দেবেন সকলেই তা মেনে নেবে। সকালবেলা দেখা গেল হযরত মুহাম্মদ (স.) সবার আগে কাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন। এটা দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করল এবং বলে উঠল, 'আল-আমিন এসেছেন, সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।' হযরত মুহাম্মদ (স.) একখানা চাদর বিছিয়ে নিজ হাতে পাথরটি চাদরের মাঝখানে রাখলেন। তারপর সকল গোত্রের সরদারকে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা সকলে মিলে চাদরটি বহন করে যথাস্থানে নিয়ে গেল, হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজ হাতে পাথরখানা কাবার দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। ফলে জাতি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হতে বেঁচে গেল এবং সকলে পাথরটি বহনের সম্মান পেয়ে খুশি হলেন।
নবুয়তপ্রাপ্তি ও আরবের লোকদের প্রতিক্রিয়া
হযরত মুহাম্মদ (স.) শৈশবকাল হতেই মানুষের মুক্তি ও শান্তির কথা ভাবতেন। যুবক বয়সে তাঁর এ ভাবনা আরও গভীর হতে থাকে। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহের পর তিনি সাধনা ও ধ্যান আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি মক্কার অদূরে হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন, কীভাবে মানবজাতিকে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা ও শিরক হতে মুক্ত করবেন ও এক আল্লাহর পথে নিয়ে আসবেন। এভাবে তিনি হেরা গুহায় প্রায় ১৫ বছর ধ্যানমগ্ন থাকেন। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন, অবার হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যানে মগ্ন হতেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র রমযান মাসের ২৭ তারিখ নবুয়ত লাভ করেন।
নবুয়ত লাভের পর তিনি লোকদের এক আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেন। মক্কার কাফিররা তাতে বাধা দেয়। তাই তিনি গোপনে ইসলামের পথে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। আরবের প্রভাবশালী মহল সবসময় তাঁর কাজের বিরোধিতা করতে থাকে। তারা হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তাঁর অনুসারিদের নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স.) অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে তাদের অত্যাচার সহ্য করেন এবং নীরবে এক আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করতে থাকেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) আরব সমাজের কুসংস্কার দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
Read more